সুমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ছে । তার বইয়ে সে নারী উদ্যোক্তার কথা দেখলেও এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা কম দেখে সে খুবই হতাশ। সে দেখে গার্মেন্টসগুলোতে বেশির ভাগই নারী শ্রমিক । রাস্তায় উন্নয়নের কাজেও সে মেয়েদের দেখে তার মন বড়ই খারাপ হয়। সে দেখছে তার পরিচিত এক বড় বোন এলাকার মেয়েদের সংগঠিত করে তাদের সেলাই, এমব্রয়ডারি ও হাতের কাজ শিখিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। তাদের উৎপাদিত সামগ্রী তিনি প্রথমে কষ্ট করে ঢাকায় নিয়ে বিক্রয় করতেন । এখন আর তার প্রয়োজন পড়ে না । ঢাকায় থেকে অর্ডার দিয়ে লোকেরা এসে মালামাল নিয়ে যায়। সে ভাবছে তার এ বোনটি প্রকৃতই একজন নারী উদ্যোক্তা। সেও লেখাপড়া শিখে নারী উদ্যোক্তা হয়ে দেশের নারী সমাজকে এগিয়ে নেবে এটা সে ঠিক করে ফেলেছে।
নারী উদ্যোক্তা বলতে এমন কোনো নারীকে বুঝায় যিনি তার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে কোনো ব্যবসায়কে সংগঠিত ও পরিচালনা করেন । অনেক সময়ই নারীরা পুরুষের সহযোগী হিসেবে ব্যবসায় কাজে সহযোগিতা করে থাকেন । সেক্ষেত্রে তাদেরকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দেখা হয় না। যিনি নিজের মালিকানায়, নিজের উদ্যোগে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যবসায়কে সংগঠিত করে পরিচালনা করেন তাকে বাস্তবিক অর্থে নারী উদ্যোক্তা বলে । শিল্পনীতি ২০১০ এ প্রবর্তিত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এমন কোনো মহিলাকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গণ্য করা হবে। যিনি কোনো ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক অথবা যৌথ উদ্যোক্তা (অংশীদার) বা কোম্পানির ক্ষেত্রে এর ৫১% শেয়ার মূলধনের মালিক। অর্থাৎ নারী উদ্যোক্তা হলেন এমন কোনো মহিলা যিনি নিজস্ব মালিকানায় কোনো একমালিকানা ব্যবসায় গড়ে তুলেছেন বা অংশীদারি ব্যবসায় বা কোম্পানি সংগঠন গড়ে তুললেও তার ৫১% শেয়ারের মালিক । অর্থাৎ শুধুমাত্র অংশীদারির খাতায় নাম থাকলে বা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হলেই তাকে নারী উদ্যোক্তা বলা যাবে না ।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ে নারী উদ্যোক্তার আগমন হার আশাব্যঞ্জক নয়। অথচ নারী-পুরুষ সমানভাবে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে না এলে একটা জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর ক্ষমতায়নের চেষ্টায় নারীদের ঋণ দিচ্ছে। তাতে তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কুটির শিল্প, পোলট্রি, ডেইরি, ছোট ব্যবসায় গড়ে তুলতে উৎসাহিত হচ্ছে । কক্সবাজারে গেলেই দেখা যাবে উপজাতি নৃগোষ্ঠীর মেয়েরা সুন্দরভাবে দোকান চালাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। বিদেশে এ হার অনেক বেশি। ব্যাপকভিত্তিতে মাহিলাদের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রশিক্ষণসহ মূলধন সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছে। নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসার হার উৎসাহব্যঞ্জক হারে বাড়বে এটা আশা করা যায় ।
একাগ্রতা, নিষ্ঠা আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিজেকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব- এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নারী উদ্যোক্তা রেহানা কাশেম। মাত্র ৬ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় শুরু করে এখন তার পুঁজি ৫০ লাখ টাকারও বেশি । নারী উদ্যোক্তাদের কাছে তিনি এক অনন্য আদর্শ ।
একজন সাধারণ গৃহবধু হিসেবে অবসর সময়ে কুশন কভার, টেবিল ম্যাট, ন্যাপকিন ইত্যাদি তৈরি করতেন । প্রতিবেশী এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছে তার এই কাজগুলো ছিল পছন্দের। তারাও অনুরোধ করতেন এসব ডিজাইনের পণ্যগুলো তাদের তৈরি করে দিতে। নিজের এই মেধা এবং সৃজনশীলতাকে পুঁজি করে ১৯৮২ সালে অপেশাদারভাবেই তিনি শুরু করেন হস্তশিল্প ব্যবসায়। কিন্তু হঠাৎ করেই স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং বাজার থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে তিনি পুরোপুরি পেশাদারিভাবেই এই ব্যবসায় শুরু করেন। এ সময় তার প্রাথমিক পুঁজি ছিল মাত্র ৬ হাজার টাকা । মেয়েদের পোশাক ডিজাইনিংয়ে মনোযোগ দেন তিনি। ১৯৮৫ সালে এসে তার পুঁজি দাঁড়ায় প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ বছর তিনি তার ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন সাতরং হ্যান্ডিক্রাফটস অ্যান্ড ফ্যাশন নামে । এ সময় প্রথম অর্ডারটি পান ফ্যাশন হাউস ভূষণের কাছ থেকে । তার কাজে মুগ্ধ হয়ে ভূষণের স্বত্বাধিকারী তাকে পাঞ্জাবি তৈরি করার কার্যাদেশ দেন। সেই থেকে শুরু । আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । ১৯৯৫ সালে তিনি মাইডাস থেকে ২ লাখ টাকা জামানতবিহীন ঋণ পেলেন । মাইডাসের এই ঋণের মাধ্যমে তিনি তার সেলাই মেশিনের সংখ্যা বাড়িয়ে নিলেন ১৮ থেকে ৩৭-এ । অল্পদিনের মধ্যে তার একাগ্রতা এবং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি মাইডাসের শীর্ষ ব্যক্তিদের নজরে এলো। তারা তাকে একজন ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা না করে তার ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক বাড়ানোর কাজে সহায়তা করলেন। মাইডাস মিনি মার্টের সদস্য হলেন তিনি। এভাবে তার পোশাক সমাজের আরেকটি বড় অংশের কাছে পরিচিতি পায় এবং প্রশংসা কুড়ায় । সময়ের ব্যবধানে মাইডাস তাকে পুনরায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা ঋণ দেয় ।
মাত্র ৬ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসায় শুরু করে রেহানা কাশেমের নিজস্ব পুঁজি এখন প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। বর্তমানে ঢাকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার প্রতিষ্ঠানের শোরুম রয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন প্রায় ৩শ কর্মী। তার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার এখন দেড় কোটি টাকা। ব্যবসায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রেহানা কাশেম একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০০ সালে জবস, ইউএসএইড, ২০০১ সালে ডেইলি স্টার অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৩ সালে অনন্যা বিজনেস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন তিনি ।
একটু চিন্তা ও চেষ্টা থাকলেই যে কিছু করা সম্ভব তার প্রমাণ বরিশালের রাধা রাণী ঘোষ। মাত্র এসএসসি পাস পরিশ্রমী ও সাহসী নারী এখন নগরীর অমৃত লাল দে সড়কের নতুন বাজার এলাকায় মেসার্স রাধা বস্ত্রালয় নামক একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী । রাধা রাণীর স্বামী ছোট একটি রেস্তোরা চালাতেন। সংসারে টানাটানি ঘুচাতে রাধা রাণী প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। ঘটনাক্রমে ভাইয়ের সাথে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবাজার থেকে কয়েকটি শাড়ী কিনলেন নিজের ও প্রতিবেশীদের জন্য। শাড়ীগুলো খুব পছন্দ হলো তাদের। আর সেখান থেকেই ঘুরে গেল রাধা রানীর জীবনের মোড়। ঢাকা থেকে শাড়ী কিনে ঘরে বসেই বিক্রি করতে শুরু করলেন। টিউশনি ছেড়ে শাড়ি ও বাচ্চাদের পোষাকের একটি দোকান দিলেন। ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্য বেসিক ব্যাংক, বরিশাল শাখা থেকে ২ লাখ টাকা এসএমই ঋণ নেন। পরবর্তিতে আরো ৩ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসায়ের প্রসার ঘটিয়েছেন।
আরও দেখুন...